সোশ্যাল মিডিয়া ও নারী: সম্মানহানি নাকি সুরক্ষার দায়?
আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বলতে গেলে, ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমাদের দিন কাটে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, আর টুইটারে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের জন্য যেমন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার একটা দারুণ উপায়, তেমনই আবার নিজেদের ভাবনাচিন্তা বা সৃজনশীলতা প্রকাশেরও একটা বড় জায়গা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, যে জায়গাটা হওয়া উচিত ছিল বিনোদন আর সুস্থ সংস্কৃতির আধার, সেটাই এখন অনেকের কাছে হয়ে উঠেছে সম্মান আর ইজ্জত নিয়ে খেলার একটা মঞ্চ।
যেখানে সুরক্ষার কথা, সেখানে কেন সম্মানহানি?
বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। যেখানে আমাদের সমাজ এবং আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব একজন মেয়ের সম্মান রক্ষা করা, সেখানে আমরা নিজেদের বিনোদনের জন্য সেই সম্মান নিয়েই ছিনিমিনি খেলছি। সামান্য একটা ছবি বা ভিডিও, যা হয়তো একান্তই ব্যক্তিগত, তা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। আর তার নিচে চলছে অশ্লীল আর কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের বন্যা। একটা মেয়েকে হেনস্তা করতে, তার সম্মানকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে আমরা যেন বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছি না।
বিকৃত মানসিকতা ও 'Anonymity'-র আড়ালে
সবচেয়ে হতাশাজনক দিকটা হলো, এই ধরনের কাজের পেছনে বেশিরভাগ সময়ই থাকে এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা। অনেকে হয়তো শুধুমাত্র মজা করার জন্য বা আলোচনায় থাকার জন্য এমনটা করে। আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে অন্যের জীবন নষ্ট করতে চায়। এই ভার্চুয়াল জগতে আমরা এক ধরনের মুখোশ পরে চলি, যেখানে আমরা যা ইচ্ছা তাই বলতে বা করতে পারি। কারণ আমরা জানি, আমাদের পরিচয় সহজে কেউ জানতে পারবে না। এই গোপনীয়তা বা 'anonymity'-র সুযোগ নিয়ে অনেকে সাইবার বুলিং-এর মতো জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছে।
আমাদের করণীয়: এক সুস্থ ডিজিটাল সমাজের দিকে
আমাদের মনে রাখতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়া শুধু একটা প্ল্যাটফর্ম নয়, এটা আমাদের সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবিকে যদি আমরা সুন্দর আর সম্মানজনক করে না তুলতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী শিখবে?
- সচেতনতা বৃদ্ধি: কোনো কিছু শেয়ার করার আগে একবার ভাবুন, এই জিনিসটা কি একজন মানুষের সম্মান নষ্ট করবে? যদি উত্তর 'হ্যাঁ' হয়, তাহলে সেটা থেকে বিরত থাকুন। কারণ একটি মন্তব্য বা একটি শেয়ার হয়তো আপনার জন্য সামান্য, কিন্তু একজন মানুষের জীবনের ওপর তার প্রভাব হতে পারে মারাত্মক।
- আইনের কঠোর প্রয়োগ: শুধু সরকারের কঠোর আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, এর সঠিক এবং দ্রুত বাস্তবায়নেও জোর দিতে হবে।
- শিক্ষামূলক উদ্যোগ: স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিষ্টাচার এবং সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে শিক্ষিত করা জরুরি।
- রিপোর্ট করুন: যদি আপনি এমন কোনো হয়রানি বা সম্মানহানির ঘটনা দেখেন, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করুন। আপনার একটি রিপোর্ট হয়তো একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে সোশ্যাল মিডিয়াকে একটি সুস্থ ও নিরাপদ জায়গা হিসেবে গড়ে তুলি। সম্মানহানি নয়, বরং সম্মান রক্ষা হোক আমাদের সবার প্রধান লক্ষ্য। কারণ ডিজিটাল স্পেসে আমরা যে সংস্কৃতি তৈরি করব, সেটাই আমাদের বাস্তব সমাজের আয়না হয়ে উঠবে।
0 Comments